আপনার জীবনে কোনো একটি বিষয় কেনো কাজ করছে না, তা পরিষ্কারভাবে বুঝতে হলে নিজের মানসিক তথা মস্তিষ্কের মূল বিষয়গুলো সম্পর্কে বুঝতে হবে। খাবার বা যৌনতা বা নিষিদ্ধ সব বিষয়ের প্রতি মনযোগ চলে যাওয়াকে আমরা কেনো আটকাতে পারি না? অথবা মানুষ যাই করে, আমরাও কেনো তাই করতে চাই? এমন নানা প্রশ্নের জবাব পেতে ১০০টি মস্তিষ্ক এবং একে নিয়ে তৈরি নানা মানসিক অবস্থা এবং বৈশিষ্ট্যের কথা খুঁজে বের করার প্রয়াস পেয়েছেন ব্যবহার বিষয়ক বিজ্ঞানী ড. ওয়েনস্যুয়েঙ্ক।
এই একশোটি বিষয়ের মধ্য থেকে সবচেয়ে কার্যকর এবং দারুণ ৪৮টি মানসিক অবস্থা এবং এর বৈশিষ্ট্য আপনাদের জানার জন্য কিস্তি আকারে তুলে ধরা হলো। এই বিষয়গুলো মাথায় প্রবেশ করাতে পারলে আপনি নিজের মানসিক অবস্থা এবং সদাব্যস্ত মস্তিষ্ক নিয়ে পরিষ্কার ধারণা পাবেন। প্রতিটি বিষয় বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। আপনার জটিল মস্তিষ্ককে পরিষ্কার করতে ধারাবাহিকভাবে ৪৮টি বিষয় উপস্থাপন করা হবে।

৪. এমনকি বিভ্রান্তিও অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে
ধরুন, আপনি একটি কফি শপ থেকে দুটি 'বায়ার কার্ড' নিয়েছেন। আপনি এক কাপ কফি খান আর কার্ডে একটি করে স্ট্যাম্প লাগে। এ ক্ষেত্রে দুটো ঘটনা ঘটে।
কার্ড 'এ' : এই কার্ডের জন্য ১০টি বাক্সের স্ট্যাম্প রয়েছে। আপনি কার্ডটি পেয়েছেন মানে ওই ১০টি বাক্স খালি ধরা যায়।
কার্ড 'বি' : এ কার্ডের জন্য ১২ বাক্স স্ট্যাম্প রয়েছে। কার্ডটি যখন আপনার হাতে এসেছে তখন দুই বাক্সের স্ট্যাম্প ইতিমধ্যে কার্ডে লাগানো হয়েছে।
কার্ডটি স্ট্যাম্পে ভরে যেতে কতদিন লাগবে ? : এবার কার্ড 'এ' এবং কার্ড 'বি' এর চিত্রের মধ্যে তুলনা করুন। তবে প্রতি ১০ কাপ কফি কিনে খেলে এক কাপ কফি ফ্রি পাবেন। এখান দুটো কার্ডের কোনটি ব্যবহার করবেন তার কী ভাবার কোনো অবকাশ আছে? এর উত্তরটি আপাতদৃষ্টিতে হ্যাঁ। আপনি কার্ড 'এ' এর আগে কার্ড 'বি' দ্রুত ব্যবহার করতে চাইবেন। আর এর কারণকে বলে 'গোল গ্র্যাডিয়েন্ট ইফেক্ট'। এ বিষয়টি প্রথম ১৯৩৪ সালে গবেষণায় আসে। ইঁদুর নিয়ে হাল নামের এক গবেষক এ বিষয়ে গবেষণা করেন। একটি ইঁদুর খাবারের জন্যে গোলক ধাঁধায় দৌড়ায় এবং শেষে খাবারটি পাওয়ার পর সে আরো জোরে দৌড়ায় গোলকের শেষে পৌঁছতে।
গোল গ্র্যাডিয়েন্ট ইফেক্ট বলে যে, আপনার লক্ষ্যে পৌঁছানোর কাজটিতে ক্রমশ উন্নতি করতে থাকলে আপনি গতি বাড়িয়ে দিবেন। এই গবেষণা সংশ্লিষ্ট র‍্যান কিভেৎ, ওলেগ আরমিনস্কি এবং ইয়োহুয়াং ঝেং মনে করেন, এই পরিস্থিতিতে মানুষের আচরণ ইঁদুরের মতো।
গোল গ্র্যাডিয়েন্ট ইফেক্টের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে। তা হলো-

  • লক্ষ্যের যতো কাছে পৌঁছানো হবে ততো বেশি উদ্যোমি হয়ে উঠবে মানুষ।

  • বিভ্রান্তির মধ্যেও আপনার এই উদ্যোম বাড়তে থাকবে। যেমন কার্ড 'বি' এর ক্ষেত্রে আপনার কিন্তু কোনো উন্নতি নেই। কারণ ফ্রি কফি পেতে হলে আপনাকে ঠিকই ১০ কাপ কফি কিনে খেতে হচ্ছে। অথচ আপনার কাছে মনে হচ্ছে এতে ভালো ফল হচ্ছে।

  • মানুষ পুরষ্কার পাওয়ার উপলক্ষে যোগ দিতে চায়। যারা ওই কফি শপের কার্ড পাননি তারাও কার্ড পেলে বেজায় খুশি হবেন।

  • কোনো গানের ওয়েবসাইট তাদের গান পছন্দ করে রেট করার ক্ষেত্রে পুরষ্করের ঘোষণা দিলে মানুষ তার করতে শুরু করবে। পুরষ্কারের কাছাকাছি চলে গেলে তাদের ওয়েবসাইটটাতে ঢুঁ মারার তাগিদ বেড়ে যাবে।

  • লক্ষ্যে পৌঁছার পর প্রণোদনা এবং ক্রয়ের মধ্যে সাম্যাবস্থা নির্ধারিত হয়। একে বলে 'পোস্ট-রিওয়ার্ড রিসেটিং ফেনোমেনন'। আপনি যদি নিম্ন স্তরের কোনো পুরষ্করের ব্যবস্থা করেন তবে সেখানে পৌঁছতে মানুষ আগ্রহ বোধ করবে না। এতে আপনি ক্রেতা হারানোর ঝুঁকিতে পড়বেন।

৫. মানুষ তা দেখার আশা করে তাই দেখে
২০০৯ এর ডিসেম্বরে টেক্সাসের হাস্টনের ব্যবসায়ী ফরিদ সাইফ তার গুলিভরা পিস্তলটি ল্যাপটপের পকেটে নিয়েই এয়ারপোর্টের দিকে ছুটলেন ফ্লাইটটি ধরার জন্য। টেক্সাসে অস্ত্র নিয়ে চলা বৈধ। কিন্তু তিনি অস্ত্রটি বের করে নিতে বেমালুম ভুলে গেছেন। হাস্টন এয়ারপোর্টের চেকিংয়ের সময় কেউ তার ল্যাপটপের ব্যাগে অস্ত্রের নিশানা খেয়াল করলেন না। তিনি নিজেই ব্যাপারটি টের পেলের যাত্রার শেষে। অথচ চেকিংয়ের সময় বিপদজনক যেকোনো কিছু স্ক্যানিংয়ে ধরা খাবে।
ইউএস এর হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অস্ত্র, বোমের সরঞ্জামসহ অন্যান্য অবৈধ জিনিসপত্র শরীরে বা ব্যাগে লুকিয়ে নিরাপত্তাবেষ্টনী অতিক্রমের সময় তাদের শনাক্ত করা কতোটুকু সফল হয় তার নানা পরীক্ষা চালায়। এর ফলাফল প্রকাশ না করলেও জানা যায় যে, তার সত্তর ভাগই বিফলে গেছে। ওই ব্যবসায়ী ভদ্রলোক কোনো সন্ত্রাসী নন। নিরাপত্তাবেষ্টনীতে তার কাছে কোনো অবৈধ কিছু থাকবে বলে আশা করেননি দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মীরা। আর এ কারণেই তার অস্ত্রটি কারো চোখে পড়েনি।
একটি ধারাবাহিক ঘটনায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে মানুষ : একটি শ্যাম্পুর বোতল এতো বড় কেনো এটা নিরাপত্তাকর্মীদের চোখে পড়েছে, কিন্তু গুলিসমেত অস্ত্র তাদের চোখ এড়িয়ে গেলো কেনো? গবেষণায় দেখা গেছে, যা ঘটে থাকে তা থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের মনে এক ধরনের সাধারণ ঘটনার অবয়ব কাজ করে, এমনটিই ঘটে থাকে। অথচ যা সাধারণত ঘটে থাকে না তা চোখ এড়িয়ে যাবেই।
শ্যাম্পুই আশা করা হয়েছিল : ওখানে দায়িত্বরত কর্মী কী কী দেখছিলেন? তারা আসা যাওয়া মানুষের চালচলন খেয়াল করছিলেন। তাদের চেকিংয়ে বেশিরভাগ সময় শ্যাম্পু বা কসমেটিক পণ্য বা প্রযুক্তি পণ্য ইত্যাদি বেশি নজরে পড়ে। কাজেই এসবকে কেন্দ্র করেই তাদের বিবেচনা বোধ কাজ করছিল। তাদের মাথায় এমন চিন্তা ছিলো না যে, এখানে কোনো বোম বা অস্ত্র থাকবে। অথবা যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা পূর্বে কখনো বোম বা অস্ত্র ধরার অভিজ্ঞতা লাভ করেননি। অবচেতনভাবে মানুষের মনে তার অভিজ্ঞতাই বারবার খেলা করে।
৬. মানুষ গল্পের আকারে তথ্য ধরে রাখতে বেশি পারঙ্গম
এই নিবন্ধের লেখক মনোবিজ্ঞানী নিজেই একদিন একটি ক্লাস নিতে গেছেন। সেদিন ছিলো ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার প্রথম ক্লাস। কিন্তু সেখানকার ছেলে-মেয়েরা তার ক্লাস করতে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না। শিক্ষক ক্লাসে প্রবেশ করে বুক ভরে শ্বাস নিলেন এবং মুখে হাসি নিয়ে জোর কণ্ঠে বললেন, 'হ্যালো এভরিওয়ান'। এতে সবাই তার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকালো। এর আগে ক্লাসে সবাই ইমেইল দেখছিলেন, মোবাইল টিপছিলেন আবার কেউবা পত্রিকা পড়ছিলেন। এটি এমন এক মুহূর্ত যখন একটি সেকেন্ড পেরোতে মনে হয় এক ঘণ্টা কেটে গেলো।
হঠাৎ একটি গল্প বলতে চাইলেন শিক্ষক। এ বাক্যে শুধুমাত্র 'গল্প' শব্দটির জন্য আগ্রহে সবার চোখ চকচক করে উঠলো। আগামী ৫/৬ সেকেন্ডের মধ্যে তাকে একটি গল্প শুরু করতে হবে এবং  তিনি তাই করলেন। এতে সবাই যার যার কাজ ফেলে শিক্ষকের দিকে মনযোগ দিলেন।
গল্প অনেক শক্তিশালী : গল্প সব সময় মানুষের মনযোগ টেনে নেয়। শুধু তাই নয়, গল্পের আকারে যেকোনো তথ্য মানুষের মনে গেঁথে যায়।
সত্যিকার গল্পের কাঠামো তৈরি করুন : অ্যারিস্টটল গল্পের মূল ভিত্তি চিহ্নিত করেন। তখন থেকেই মানুষ তার ধারণাকেই ধারণ করে আসছে। গল্পের একটি মডেল হলো তিন কার্যের কাঠামো। শুরু, মধ্যম এবং শেষ। এটি শুনতে খুব অপরিচিত মনে হচ্ছে না। তবে অ্যারিস্টটল যখন দুই হাজার বছর আগে এ কথা বলেছিলেন, তখন তা যথেষ্ট আধুনিক ছিলো।
এই মডেল অনুযায়ী, শুরুতে পাঠক বা দর্শকদের সামনে গল্পের চরিত্র এবং পরিস্থিতি এবং টানাপড়েনের সঙ্গে পরিচয় ঘটবে। মাঝখানের অংশ বেশ ছোট হতে পারে। এই অংশে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে গল্পের চরিত্রগুলো এগিয়ে যাবে। আর শেষে টানাপড়েন চরম মুহূর্তে পৌঁছে তা পরিণিতি লাভ করবে।  
কার্যকারণ বোঝাতে গল্পের ব্যবহার হতে পারে : গল্প কার্যকারণ ব্যাখ্যা করে। কারণ গল্প সময়ানুক্রমিকভাবে বর্ণনার মাধ্যমে এগোয়। পটভূমিতে না থাকলেও গল্প কার্যকারণ দেখাতে পারে। আর গল্পের এই কার্যকারণ খুঁজতে সব সময় সচেষ্ট থাকে মানুষের মস্তিষ্ক।
যেকোনো যোগাযোগে গল্প গুরুত্ববহ : যোগাযোগ স্থাপনের জন্যেও গল্প কার্যকর। যেকোনো পরিস্থির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য আপনার শুধু একটা প্রাসঙ্গিক গল্প বেছে নিতে হবে।
৭. আপনার অবচেতন মন আগে বুঝতে পারে
আপনি একটি কম্পিউটার কিনতে গেছেন। বিক্রেতা দারুণ একটি অফার আপনাকে দিয়েছেন। কিন্তু তবুও এটাকে ভালো মনে হচ্ছে না আপনার কাছে। কেনো আপনার এমন মনে হচ্ছে জিজ্ঞাসা করলে হয়তো আপনি জবাব দিতে পারবেন না। এর কারণও দর্শাতে পারবেন না আপনি। তাহলে হচ্ছেটা কী?
অবচেতন মন চেতনার চেয়ে বেশি দ্রুত কাজ করে : সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মানুষের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে তাদের আবেগ কীভাবে কাজ করে সে বিষয়ে একটি হাইপোথিসিস দিয়েছেন অ্যান্টোনিও দামাসিও। বাজারে দ্রব্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে এটি একটি অর্থনৈতিক তত্ত্ব। একে 'সোমাটিক মার্কেট হাইপোথিসিস' বলে। এক্ষেত্রে মানুষের অবচেতন মন তাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তার করে যা চেতন মন পরে ধরতে পারে।
তাসের একটি খেলা : কয়েকজনের মধ্যে এটি একটি তাসের জুয়ার পরীক্ষা। প্রত্যেকেই দুই হাজার ডলার করে ছাপানো অর্থ পাবে। তাদের বলা হয়, যতো কম পরিমাণে সম্ভব এই অর্থ হারতে হবে। টেবিলে চারভাগে তাস রাখা হয়। অংশগ্রহণকারীরা তাদের পছন্দের একটি ভাগ থেকে একটিমাত্র করে তাস তুলতে পারবে। এভাবে তারা ক্রমাগত তাস তুলতে থাকেন যতোক্ষণ না তাদের থামতে বলা হয়। তারা জানতো না যে খেলাটি কতোক্ষণ চলবে। এদের বলা হয়েছিল যে, একেকবার তারা একটি করে তাস তুলবেন আর অর্থ পাবেন। তাদের এও বলা হয় যে, তারা হারতেও পারেন।

Kindly Share This Post »»

0 comments :

Post a Comment